ইদানিং আর মন খারাপ ব্যাপারটা আমাকে আক্রমন করে না। মন খারাপ বা বিষন্নতা যখন আসে তখন চেষ্টা করি তা দূর করতে। মনে মনে বলি দূর ফালতু মন খারাপ করার মত সময় নেই আমার। ব্যাপারটাতে দারুণ কাজ হয়। কিন্তু এখন আমার মন খারাপ। কিন্তু কেন? কারন আম্মা অসুস্থ। অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পর দেখি আম্মা চুপচাপ বসে আছে। চেহারায় অসুস্থতার ছাপ। এটা নতুন নয় প্রায়ই আম্মার মাথা প্রচন্ড ঘুরায়, প্রেসার বেড়ে যায়।
আম্মার করুন অসহায় অসুস্থ মুখটা দেখতে ভালো লাগে না আমার। এই মানুষটা আমি বাহির থেকে বাসায় আসলেই দৌড়ে আমার জামা-কাপড় এনে দেয়। গামছা এনে দেয়। তারপর বলে, যা তাড়াতাড়ি হাত-মুখ ধুয়ে খেতে আয়।
খেতে এসে অবাক হতে হয়। কেননা আম্মা সব সময় আমার প্রিয় খাবারগুলো রান্না করে। এই পৃথীবিতে একমাত্র ওনিই জানেন আমার প্রিয় খাবার কি। আমি নিজে খাবার-দাবার নিয়ে বেশ উদাসিন এবং অনেক বিবেচনা করে খাই। বেশিভাগ সময় আম্মা নিজ হাতে আমাকে খাইয়ে দেয়। এই দৃশ্য দেখে বাবা প্রায়ই বকাবকি করে। এই বুড়া ছেলেকে কি হাত দিয়ে খাইয়ে দিতে হয়।
আম্মা তখন বলে, তুমি ওকে বুড়া বলো কেন। আমার ছেলে আমার কাছে সব সময় ছোটই আছে।
আমি অবাক হয়ে যাই আম্মার ধৈর্য শক্তি দেখলে। যতদূর মনে পড়ে আম্মা আমাকে খুব একটা বকাবকি করেনি ছোটবেলায়। কোন দোষ করলে বুঝাতেন ধৈর্যসহ এবং বলতেন, মেরে কি লাভ। মারলে বাচ্চাকাচ্চার ভয় কমে যায়।
ছোট বেলায় আম্মার কথাগুলো প্রয়াই মনে পরে। যখন কোন খারাপ কাজ করার কথা মনে আসে তখন আমার কথাগুলো মনে পড়ে। আসলে সন্তান পরিবার থেকে যে শিক্ষা পায় তা কোথায় পায় না। পরিবার সবচেয়ে বড় শিক্ষক। ব্যাপারগুলো এতদিন পাঠ্য পুস্তকে পড়েছি কিন্তু এই বয়সে এসে বিস্তারিত বুঝতে পারছি।
কেউ যদি আমাকে প্রশ্ন করে এই পৃথীবি মাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসো তাহলে আমার প্রথম উত্তর থাকবে আমার ‘মা’। হ্যাঁ তিনিই J এই মানুষকে মুখে একটু হাসি দেখলে আমার এতটা আনন্দ লাগে আমি বলে বুঝাতে পারব না।
গত মাসে চলে গেলো ১৪ ফেব্রুয়ারি। সবাই জানে এই দিন ‘বিশ্ব ভালোবাস’ দিবস। আমাদের সবার মনে ধারণা এই ভালোবাসা দিসবে প্রেমিকাকে নিয়ে ঘুরতে হয়, ডেটিং করতে হয়, দামি গিফট দিতে হয় ইত্যাদি কত কি???? কিন্তু দিনটা আমার কাছে বেশ গুরুত্ব পূর্ণ কেননা এই দিনে ৩৬ বছর আগে বাবা-মায়ের বিয়ে হয়। এই দিনটিতেই আম্মা-আব্বার বিবাহ বার্ষিকী। সংসার নামক গাড়ি টানতে টানতে বাবা মা কখনো এই বিবাহ বার্ষিকী পালন করতে পারেনি। কখনো কেক পর্যন্ত কাটেনি। তাই আমি এবার চিন্তার করলাম আম্মাকে এবার সারপ্রাইজ দিব।
চাকরি’র সেলারী পেয়েছিলাম সেই সময়। সেই ভাবা সেই কাজ। আম্মা অনেকদিন থেকে বলেতেছিলো একটা ওভেন কিনে দেয়ার জন্য। তাই ১৪ ফেব্রুয়ারিদিনের সন্ধ্যায় মিরপুর এক নম্বর থেকে একটা ওভেন ও কেক কিনে আনি। দরজা খুলে আম্মা খুব অবাক বলে কি করসিস তুই :O তোর কি টাকা পয়সা বেশি হয়েছে গেছে। চোখ রাগানি দিয়ে বকা দিলো।
আমি জানি আম্মা যতই বকা দেয় না কেন মনে মনে বেশি খুশি হয়েছেন। আমি মুচকি মুচকি হেসে বললাম, আম্মা তুমি খুশি হউ নাই । সত্যি করে বলো।
আম্মা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে, হ্যাঁ হয়েছি । তবে একগুলো টাকা কেন নষ্ট করলি।
আমি বললাম, নষ্ট কই করলাম । এই যে তুমি খুশি হয়েছো।
আম্মা হাসতে হাসতে বলে, পাগলা একটা।
আহা ! মায়ের হাসি মাখা মুখ খানা। দেখতে বড়ই আনন্দ লাগে। কোনদিন মায়ের প্রতিদান শোধ করতে পারব না। তবুও একটু মায়ের মুখে হাসি ফোটালে পারলে মন্দ কি? মায়ের মুখে হাসি J ভালোবাসা দিবসে J বাবা-মায়ের বিবাহ বার্ষিকীতে। জীবনটাকে তখন সত্যি আনন্দময় মনে হয়।
ছবি বা উপন্যাসে পড়েছিলাম আনন্দে অনেক সময় মানুষের চোখে জল আসে। ব্যাপারটি যখন শুনেছিলাম তখন হাস্যকর মনে হতো। কিভাবে সম্ভব। আনন্দের সময় তো মানুষজন হাসবে। কিন্তু তাই বলে চোখে জল ? সেটা কিভাবে সম্ভব। কিন্তু বাস্তব্যে তাই হলো। আম্মার আনন্দ মুখখানা দেখে আমি ওয়াশরুমে গেলাম ফ্রেশ হতে। তখন কেন যেন আনন্দের চোখে জল এলো। আমার এই মা সারা জীবন কষ্ট করে গেছে। নিজে কখনো বিলাসী জীবন যাপন করেনি। খুব সামান্য ছিলো চাওয়া। পুরা সংসারটি পিছনে সময়গুলো পার করেছে। কোথায় ঘুরতে যায় নি। নতুন নতুন শাড়ি বা পোশাকের প্রতি ছিলো না কোন মোহ। সব কিছু আমাদের দিযে চেষ্টা করতে আমাদের মুখে হাসি ফোটাতে। মায়ের ইচ্ছাগুলো কখনো পূরণ করতো না।সেদিন মাকে একটু খুশি করতে পেরেই এতটা ভালো লাগছিলো আমার যে ওয়াশরুমে মুখ ধুয়ার সময় দেখি আমার চোখে বিন্দু বিন্দু জল। অবাক হয়ে গেলাম আমি কাঁদছি কেন? পরক্ষণে মনে হলো, যদি আমার মা না থাকে পৃথীবিতে আমি কিভাবে থাকব।পৃথীবির নিয়ম একটা সময় মানুষ মরে যাবে। আমার মা মরে গেলে আমি কিভাবে এই বিশাল পৃথীবিতে বেঁচে থাকব। মায়ের হাতের রান্না, মায়ের হাতের পরম, মায়ের ভালোবাসা ছাড়া আমার পক্ষে এই পৃথীবিতে বেঁচে থাকাটি সত্যি কষ্টকর হয়ে যাবে। আজব ওয়াশরুম প্রায় ১৫ মিনিটের কত কাঁদলাম আমি। আনন্দের মানুষ কাঁদে তা হারে হারে টের পেলাম।
জগতের সব মায়েরা ভালো থাকুক। আর আম্মা দ্রুত সুস্থ হয়ে যাক তাই চাই আপাততো। আবারও দেখবে মায়ের মুখের হাসিখানা।
Valo laglo