পুকুর ঘাটে বসে আসি। সে সন্ধ্যা থেকেই । এখন রাত ৯ বাজে।আকাশে পরিষ্কার একটা চাঁদ উঠেছে।চাঁদের ছবি পড়েছে পুকুরে। সুন্দর লাগছে দেখতে।কোন বাতাস নাই বলে পুকুরের পানি নড়চড়া করছে না। যেখানে বসে আছি, সেখান থেকে আকাশের চাঁদ আর পুকুরের চাঁদ দু’টাই একসাথে দেখা যাচ্ছে।অদ্ভুত রকমের সুন্দর লাগছে দেখতে।আশেপাসে কোথায় হাসনাহেনা ফুলের গাছ আছে। ফুলের তীব্র গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।রাতে হাসনাহেন ফুলের গন্ধে নাকি সাপ চলে আসে। আমার খুব ভয় করছে। যদি সাপ চলে আসে।আমার খুব ইচ্ছা করছে পুকুলে ঝাপ দিতে।পুকুরের যে চাঁদটা দেখা যাচ্ছে সেই চাঁদটা ধরতে।এক দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে আছে পুকুরের চাঁদের ছায়ার দিকে।
“আপু ঘরে চল” -আমার ছোট ভাই নিষাদ বলে,
“এখন যান না তুই যা”
নিষাদ আমার হাত ধরে টান দিয়ে বলে ,” আপু চল না। রাত অনেক হয়েছে আম্মু তোমাকে নিয়ে যেতে বলেছে”
“নিষাদ বললাম তো আমি এখন যাব না”
“plesae আপু চল”
“তুই যা আমি কিছুক্ষন পর আসব।”
নিষাদ চলে গেল। আমি বসে রইল একা একা পুকুরে ঘাটে। একা একা এত রাত পযন্ত পুকুর ঘাটে আমি আগে কখনো বসে থাকনি। গ্রামে খুব কম আসা হয়।এবার এসেছি মামার বিয়েতে। কিন্তু কিছুতেই যেন আমি কোথায় মন বসাতে পারছি না।
হঠ্যাৎ করে বাতাস শুরু হল। খুব বাতাস বললে ভুল হবে।এখনই যেন ঝড় হবে এমন বাতাস।পুকুরের চাঁদের ছায়াটা একবার ডানদিকে আবার বাম দিকে দোলতে শুরু করল। দেখতে ভাল লাগছে। শান্ত চাঁদটা নড়াচলা শুরু করল।দেখতে ভালই লাগছিল।আমি নাকি ছোটবেলায় খুব বাচাল ছিলাম। অনেক কথা বললাম। আমার মধ্যে একটা শিশু শিশু ভাব আছে। শিশুরা যেমন করে কথা বলে আমি মাঝে মাঝে এমন করে কথা বলি। বলতে ভাল লাগে। এজন্য আমার অনেক বন্ধুরা আমাকে খুকী বলে ডাকে। আমার এক সুন্দর নাম প্রিয়দর্শনী না ডেকে।কোন ছোট বাচ্চা দেখলে আমি তাদের কোলে না নিয়ে পারি না। আমার কাছে মনে হয় পৃথীবির সবচেয়ে সুন্দর ছোট শিশুরা।
বাতাস খুব জোরে বইতে শুরু করল।যেন এখনি ঝড় হবে। বাতাসের কারনে হাসনাহেনা ফুলের তীব্র গন্ধের সুবাস নাকি আসছে। পুকুরের চাঁদের ছায়াটা আর নেই।পুকুরে সেখানে চাঁদের ছায়াটা ছিল সেখানেটা কালো হয়ে আছে।কিছুই দেখা যাচ্ছে না।আমি তাড়াতাড়ি আকাশের দিকে তাকালাম। আকাশের চাঁদটাত্ত কালো মেঘে ডেকে গেছে।কিছুক্ষনের মধ্যেই বৃষ্টি শুরু হবে বুঝতে পারলাম। ঘারে যাওয়া উচিত।কিন্তু আমার ঘরে যেতে ইচ্ছা করছে না। বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছা করছে।বৃষ্টি আমার খুব প্রিয়। বৃষ্টি আমার আগে এতপ্রিয়ে ছিল না। হঠাৎ করে হয়ে গেল। এখন বৃষ্টি আসলে আমি আর নিজেকে স্থির রাখতে পারি না। বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে করে। মাঝে মাঝে প্রচন্ড ভয় হয় এই বৃষ্টিকে। এইজন্য দায়ী নিহাল। আর কেউ না।নিহালের কথা আবার মনে পড়ে গেল। আমি চাই না। মনে করতে এই নামটা । বারবার ভুলে থাকতে চাই । কিন্তু প্রকৃতি বার বার আমাকে মনে করিয়ে দেয়। কেন প্রকৃতি কি চায় না আমরা আমাদের অতীত ভুলে যাই।অতীতের সব কষ্ট ভুলে থাকি।না কি প্রকৃতি আমাদের কষ্ট দিতে পছন্দ করে। জানি না…….!! কিছু ভাবতে ইচ্ছা করছে না।
বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল।বাতাস প্রচুর বইতে শুরু করল। বৃষ্টির প্রতিটি ফোটা আমার শরীরের যেন কাটার মত করে আঘাত দিচ্ছে। আজ বৃষ্টিটা দেখে আমার তীব্র ভয় হচ্ছে।কিন্তু আমার ভিজতে ইচ্ছা করছে।আমি পাথরের মত করে দাড়িয়ে আছি বৃষ্টির মধ্যে। হঠাৎ দেখতে পেলাম চারপাশে শুধু করব আর করব।আমি যেন একটা করবস্থানে দাড়িয়ে আছি।চেনা পরিবেশটা হঠাৎ করে অচেনা মনে হল। বৃষ্টির শব্দআর ঝি ঝি পোকার শব্দ মিলে একটা ভৌতিক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। আবার দেখতে পেলাম করবের একপাশে একজন বৃদ্ধ মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে। চারপাশে অন্ধকার।
প্রিয়দর্শনী !! প্রিয়দর্শনী!!
বাবা ডাকছে। হঠাৎ করে আমি যেন আমার চেনা -জানা পরিবেশে ফিরে আসলাম।বাবাকে অনেক ভয় পাই। আর আমি বৃষ্টি ভিজে এটা বাবা কখনো দেখতে পারে না। একবার এই বৃষ্টিতে ভিজার কারনে আমার বিষন জ্বর হয়। এর জন্য একটা পরীক্ষা দিতে পারি নাই। এরপর থেকে বাবা আমাকে বৃষ্টি ভিজতে দেখলে প্রচন্ড রাগ করে।
ভয়ে ভয়ে বললাম , জ্বি বাবা
বাবার বলল.”ঘরে আস”
আমি সুলভ কন্যার মত ঘরে গেলাম।আম্মু মাথার পানি মুছে দিল। আমার আমার রুমে আসলাম। মোবইলটা হতে নিলাম। কিন্তু মোবাইলের নেটওয়াক নেই। মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল।ব্যাগ থেকে আমার ডায়েরীটা হাতে নিলাম। অনেক দিন। নিহালকে লিখা হয় না। যদিত্ত এখন ডায়েরী খুব একটা লিখি না। ডায়েরীর জায়গায় ব্লগে লিখি। ব্লগে প্রতিটি লেখায় নিহালের কথা বলি । যদিত্ত তা পরোক্ষভাবে । কেউ বুঝতে পারে না। ডায়েরীর মধ্যে নিহালের কিছু চিঠি আছে। এই মোবাইলের যুগেত্ত নিহাল আমাকে আদিম কালে মত করে চিঠি লিখত।ভাবতেই হাসি পায়।
কারেন্ট চলে গেছে। সারা রুম অন্ধকার। বাহিরে অনেক বৃষ্টি হচ্ছে। চাচি একটা মোমবাতি টেবিলের উপর রেখে চলে গেল। আমি দরজা আটকিয়ে চেয়ারের বসলাম। কেন যেন আজ নিহালের কথা একটু বেশি মনে পড়ছে ওকে নিয়ে লিখতে ইচ্ছা করছে। সাহস করে ডায়েরীর পাতাটা হাতে নিলাম। কলম হাতে নিলমা। মোবাতির আলো আর বৃষ্টির শব্দে চারপাশে একটা সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। খুব সুন্দর লাগছে। নিহাল থাকলে খুব মজা হত। ওর এই রকম পরিবেশ খুব পছন্দ করে।-ডায়েরী লিখা শুরু করলাম।
“নিহাল!! নামটি আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করছে।জানি ওর শুনবে না।তবুত্ত । আজ নিজের এত খারাপ লাগছে কেন বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে আমার কলিজাটা ছিড়ে বের হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। জীবনের সকল মানে অর্থহীন মনে হচ্ছে। যদিত্ত এই কথা গুলো খুব সাধারন একটা কথা মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে বাংলা ছবি কোন ডায়ালগ।
নিহাল আমাকে বাস্ত্যব জীবনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়।একথায় ওখুব সাধারন একটা ছেলে ছিল। ওর মধ্যে অসাধারনতার মত কিছু ছিল না। তার চালচলন একটু আলাদা ছিল । ও অন্য বন্ধুরা খুব ষ্টাইল করত। কিন্তু ও কোন ষ্টাইল করত না। জামা -কাপড় এর দিকে কোন খেয়াল ছিল না। সবকিছু সাধারন ছিল। আমার জানা মতে ওর হাতে গোন কয়েকটা শার্ট ছিল। অনেক সময় দেখলাম একটা শার্ট টানা কয়েকদিন পড়ে আসত।একদিন আমি বলি, “তুমি এত সাধারান কেন? একটু স্মার্ট হউ”
নিহাল বলে,” এত স্মার্ট আর ষ্টাইল করে কি লাভ?”
আমি বলি, অন্যরা যে করে”
নিহাল ,”অন্যরা যা করে আমাকে তা করতে হবে।”
আমি বলি,” যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হবে না।”
নিহাল,” যারা ছেড়া প্যান্ট আর কানে দোল পড়ে তাড়া কি খুব ভাল। সবাই কি তাদের দেখতে পারে। কোন ভদ্র মানুষ এই ধরনের মানুষদের দেখতে পারে না।”
” হুম। কি ভদ্র ছেলে আমার।” বলে আমি হাসতে শুরু করলাম।
নিহাল আমার হাসির দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।আর মনে মনে ভাবছে আচ্ছা মানুষকে হাসলে এত সুন্দর লাগে কেন? (নিহালের ডায়েরি পড়ে আমি এটা জানতে পারি)
নিহালের সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয় ফ্রেব্রুয়ারীতে। তারিখ হল ২৯।নিহাল ছিল একটা নিছক ভদ্র টাইপের ছেলে।নিহাল লেখাপড়ায় খুব ভাল ছিল। আমি ছিলাম ঠিক তার উল্টা। লেখাপড়া করতে একধুম ভাল লাগত না।লেখাপড়াকে আমার কাছে মনে হত এটা পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ। প্রায়ই নিহাল আমাকে বুঝাত একটা ভালভাবে পড়। প্রিয়দর্শনী !!!
আস্তে আস্তে আমি নিহালের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ি।জানি না। কি করে। ওর সঙ্গ ভাল লাগল। ওর সাথে টাইম কাটাতে ভাল লাগল।সারাদিন আমি ওর কথা ভাবতাম। আমি ক্লাসের সুন্দরী মেয়েদের মধ্যে একজন ছিলাম। অনেক ছেলে আমাকে প্রেমিকা বানানোর জন্য আমার পিছনে ঘুরত। আমাকে নানা ভাবে ইমপ্রেশ করার চেষ্টা করত। কিন্তু আমার কিছুই ভাল লাগত না। কথায় আছে না “love first side”। একদিন নিহল ক্লাসে না আসলে আমার তীব্র চিন্তা হত। কেন আসল না কেন? একদিন ওর সাথে কথা না বললে মনে হত আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।ওর কথা মনে হলে আমি কিছুই করতে পারতাম না। প্রতি কাজের সময় ভাবতাম ত্তকে। খাওয়ার সময় ভাবি আচ্ছা ত্ত কি এখন খাচ্ছে ?কোন সুন্দর পরিবেশে আছি তখন ভাবতাম ইস এখন যদি ত্ত কাছে থাকত। এগুলো কি প্রেম পাড়ার প্রথম লক্ষন?
দ্বিতীয় পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন